মিয়ানমারের সামরিক জান্তা সরকারের প্রেসিডেন্ট সতর্ক করে বলেছেন, দেশটির শান রাজ্যে শুরু হওয়া যুদ্ধ সরকার নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে পুরো দেশই ভেঙ্গে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হবে।
২০২১ সালে সেনা অভ্যুত্থানের পর নিয়োগ পাওয়া সাবেক জেনারেল মিন্ত সোয়ে ক্ষমতাসীন সামরিক কাউন্সিলের এক জরুরি বৈঠকে বিদ্রোহীদের কয়েকটি সমন্বিত হামলার তথ্য তুলে ধরেন। ওই হামলায় সামরিক বাহিনী বড় ধরণের ক্ষতির মুখে পড়েছে বলে জানান তিনি।
শান রাজ্যের তিনটি জাতিগত বিদ্রোহী গোষ্ঠী, যাদেরকে আরো অন্য সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো সমর্থন দিয়েছে, তারা সরকারের বিরোধিতা করে আসছে।
সম্প্রতি বিদ্রোহীরা জান্তা সরকারের বেশ কয়েকটি সামরিক চৌকি, সীমান্ত পারাপার এবং রাস্তা দখল করে নিয়েছে। এই সীমান্ত পারাপার এবং রাস্তা ব্যবহার করে চীনের সাথে স্থল বাণিজ্যের বেশিরভাগ পরিচালিত হতো।
২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে জান্তা সরকার ক্ষমতায় আসার পর এটাই তাদের জন্য সবচেয়ে বড় দুঃসংবাদ। প্রায় আড়াই বছরের লড়াই শেষে এখন মনে হচ্ছে যে, সামরিক বাহিনী দুর্বল হয়ে পড়েছে এবং হয়তো তাদের এখন পরাজিত করাটাও সম্ভব।
বিদ্রোহীদের তৎপরতার জবাবে জান্তা সরকার শত শত বিমান হামলা করেছে এবং কামান থেকে গোলা ছুড়েছে। যার কারণে হাজার হাজার মানুষ তাদের বাড়ি-ঘর ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছে।
তবে এর পরও যে ভূখণ্ডের দখল তারা হারিয়েছে তা আবার নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিতে পারেনি। উত্তরাঞ্চলীয় শান রাজ্যে এই লড়াইয়ে যে শত শত সৈন্য নিহত হয়েছে তাদের মধ্যে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল অং কিয়াও লিউইন ও রয়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। সেনা অভ্যুত্থানের পর থেকে নিহত হওয়া তিনিই সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তা।
এই হামলার আরো তাৎপর্যপূর্ণ দিকটি হলো, প্রথমবারের মতো শান রাজ্যে পরিচালিত সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো নিজেদেরকে এবং তাদের সামরিক অভিযানগুলোকে সরকারের বিরুদ্ধে দারুণভাবে ঐক্যবদ্ধ করতে পেরেছে। যাদের প্রধান লক্ষ্য হলো জান্তা সরকারকে হটিয়ে একটি গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা চালু করা।
এখানে আরো বিভিন্ন বিষয় কাজ করছে। এই তিনটি বিদ্রোহী গোষ্ঠী দীর্ঘদিন ধরেই তাদের দখলে থাকা ভূখণ্ডের সীমা বাড়াতে চেয়েছিল।
চীন-মিয়ানমার সীমান্তে তৎপরতা চালানো এসব বিদ্রোহী গোষ্ঠীর উপর চীনের প্রভাব রয়েছে। কিন্তু বিদ্রোহীরা যেভাবে তাদের তৎপরতা বাড়িয়েছে, তাতে চীন কোন বাধা দেয়নি।
এর কারণ হয়তো শান রাজ্য যেভাবে অনলাইন স্ক্যামিং সেন্টারের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে এবং সে বিষয়ে জান্তা সরকারের নিষ্ক্রিয় ভূমিকার জন্য চীন মিয়ানমারের উপর হতাশ।
এসব স্ক্যামিং সেন্টারগুলোতে হাজার হাজার চীনের নাগরিকসহ আরো বিদেশি নাগরিকদের জোর করে কাজ করতে বাধ্য করা হয়। বিদ্রোহীরা বলছে, তাদের অন্যতম একটি লক্ষ্য হচ্ছে এসব সেন্টার বন্ধ করে দেয়া।
২০২১ সালে যখন সেনা অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকে সামরিক বাহিনী এবং পুলিশ সহিংসভাবে দমন করেছিলে, তখন বিরোধীরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে, জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী সশস্ত্র বিদ্রোহের ডাক দেয়া ছাড়া আসলে তাদের সামনে আর কোন উপায় নেই।
তখন অনেকেই পালিয়ে থাইল্যান্ড, চীন ও ভারত সীমান্তে জাতিগত বিদ্রোহী গোষ্ঠীদের নিয়ন্ত্রিত এলাকায় চলে গিয়েছিল। তাদের আশা ছিল সেখানে তারা প্রশিক্ষণ এবং অস্ত্র পাবেন, যা তাদের কাছে সে সময় ছিল না।
বেশ কিছু প্রভাবশালী জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠী যেমন -কারেন, কাচিন, কারেন্নি এবং শিন- তারা এই ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট-এনইউজি এর সাথে মৈত্রী স্থাপনে সম্মত হয়। এনইউজি গঠন করেছিল মিয়ানমারের নির্বাচিত প্রশাসন যাদেরকে সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বাতিল করে দেয়া হয়েছিল।
তবে অনেকেই জান্তা সরকারের মিত্র হতে চায়নি। বিশেষ করে থাইল্যান্ড ও চীন সীমান্তের বিশালাকার শান রাজ্যের বিভিন্ন গোষ্ঠী।
নিষিদ্ধ মাদক দ্রব্যের বিশ্বের সবচেয়ে বড় উৎপাদক হিসেবে পরিচিত শান রাজ্য সম্প্রতি ক্যাসিনো এবং স্ক্যাম সেন্টারের ব্যবসারও কেন্দ্র বিন্দু হয়ে উঠেছে।
১৯৪৮ সালে মিয়ানমারের স্বাধীনতার পর থেকে সংঘাত আর দারিদ্রে নিষ্পেষিত এই রাজ্যটি যুদ্ধবাজ নেতা, মাদক ব্যবসায়ী বা জাতিগত বিদ্রোহীদের মধ্যে নানা সময় নানা ভাগে বিভক্ত হয়ে আসছে। এসব পক্ষ কখনো পরস্পরের বিরুদ্ধে আবার কখনো সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করছে।
পরস্পর বিরোধী বড় দুটি জাতিগত বিদ্রোহী গোষ্ঠী শান এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে বলে প্রচলিত থাকলেও সম্প্রতি কয়েক বছরে চারটি ছোট জাতিগত গোষ্ঠী শক্তিশালী সামরিক বাহিনী গড়ে তুলেছে।
এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী হচ্ছে ওয়া। চীন সমর্থিত এই গোষ্ঠীটির কাছে প্রায় ২০ হাজার সেনা এবং আধুনিক জটিল অস্ত্র-শস্ত্র রয়েছে।
এর পরেই আছে কোকাং, জাতিগতভাবে এরা চীনা গোষ্ঠী যাদের দীর্ঘ বিদ্রোহের ইতিহাস আছে। এরপর রয়েছে পালাউং বা টা’য়াং।
এরা পাহাড়ের উপরে অবস্থিত দুর্গম গ্রামে বাস করে। ২০০৯ সালে আত্মপ্রকাশের পর থেকে এই গোষ্ঠীটির সেনা ব্যাপকভাবে বেড়েছে।
আরো আছে রাখাইন। এরা আসলে মিয়ানমারের অপর পার্শ্বে অবস্থিত রাখাইন রাজ্য থেকে এসেছে।
কিন্তু দেশটির পূর্বাঞ্চলে তাদের বড় সংখ্যক অভিবাসী জনসংখ্যা রয়েছে যারা আরাকান আর্মি প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করেছে। বর্তমানে মিয়ানমারের সবচেয়ে শক্তিশালী সশস্ত্র গোষ্ঠী রয়েছে এদের।
১৯৮৯ সালে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর সাথে একটি অস্ত্র বিরতিতে সম্মত হয়েছিল ওয়া গোষ্ঠী। যার কারণে তারা সশস্ত্র সংঘাত থেকে বিরত থেকেছে।
তারা বলছে, জান্তা এবং বিরোধীদের সংঘাতে তারা নিরপেক্ষ অবস্থানে রয়েছে। কিন্তু সারা দেশে থাকা সামরিক বাহিনী বিরোধী বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো এদের কাছ থেকেই অস্ত্রের সরবরাহ পায় বলে মনে করা হয়।
অন্য তিনটি জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠী হচ্ছে- কোকাং এমএনডিএএ, টা’য়াং টিএনএলএ এবং আরাকান আর্মি- এরা মিলে একটি যৌথ বাহিনী গঠন করেছে যার নাম দেয়া হয়েছে ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স।
সেনা অভ্যুত্থানের পর থেকে তারা বিচ্ছিন্নভাবে সামরিক বাহিনীর সাথে সংঘাতে জড়িয়েছে। তবে সব সময়ই তারা নিজেদের ভূখণ্ড প্রসারিত করতেই এই সংঘাত করেছে, এনইউজি এর সমর্থনে নয়।
এই তিনটি বিদ্রোহী গোষ্ঠীই মিয়ানমারের অন্যান্য অঞ্চল থেকে আসা ভিন্ন মতাবলম্বীদের সফলভাবেই আশ্রয়, সামরিক প্রশিক্ষণ এবং অস্ত্র দিয়েছে।
কিন্তু চীনের সীমান্তের কাছে অবস্থান হওয়ার কারণে তাদেরকে চীনের উদ্বেগ নিয়েও মাথা ঘামাতে হতো যাতে করে সীমান্ত স্থিতিশীল থাকে এবং বাণিজ্য চলমান থাকে। চীন জান্তা সরকারকে কূটনৈতিক সহায়তা দিয়ে আসছে এবং এনইউজি থেকে নিজেদের দূরে রেখেছে।