স্বাধীনতার পর হতে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে মোটামুটি ভারসাম্যমূলক পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করে এসেছে। বৃহৎ শক্তিগুলোর দ্বন্দ্ব থেকে সব সময় দূরে থাকার চেষ্টা করেছে। এই প্রথম দেশটি নিজেদের এমন একটি অবস্থানে দেখতে পাচ্ছে, যেখানে ইচ্ছায় হোক কিংবা অনিচ্ছায় হোক, এরকম একটি দ্বন্দ্বে তাদের জড়িয়ে পড়তে হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের মিত্র দেশগুলোর ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্রাটেজি এই দ্বন্দ্বের কেন্দ্রে আছে। মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে বড় ধরনের বাঁক বদল ঘটেছিল ২০১৭ সালে। ওই বছরের ডিসেম্বরে যুক্তরাষ্ট্র চীনকে তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ বা বিআরই নামের যে মহা-পরিকল্পনা নিয়ে চীন বিভিন্ন দেশে প্রভাব বিস্তার করছে, যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্রাটেজি ছিল মূলত তার পাল্টা পরিকল্পনা, চীনকে ঠেকানোর কৌশল।
২০১৭ সালের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র যত ধরনের প্রতিরক্ষা, সামরিক বা কূটনৈতিক দলিল প্রকাশ করেছে, তার সব কিছুর কেন্দ্রে আছে চীন। যুক্তরাষ্ট্রের সব কৌশলের একটাই লক্ষ্য, চীন যেন কোনো ভাবেই মার্কিন স্বার্থ ক্ষুণ্ণ করতে না পারে। আর চীনকে ঠেকানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্রের এসব কৌশলের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্রাটেজি বলে মন্তব্য করেছেন মালয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ সৈয়দ মাহমুদ আলী।
তিনি আরো বলেন, ভারত এবং প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের যত মিত্র দেশ আছে, এই ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্রাটেজিতে তাদেরকে একটি চীন-বিরোধী জোটে জড়ো করতে চায়। এই জোটের অনেক ধরনের লক্ষ্য আছে- সামরিক, অর্থনৈতিক, প্রযুক্তিগত এবং কূটনৈতিক। তবে সবকিছুর উপরে মূল লক্ষ্য একটাই- চীন যেন কোনো ভাবেই যুক্তরাষ্ট্রকে বিশ্বের এক নম্বর ক্ষমতাধর দেশের অবস্থান থেকে বিচ্যুত করতে না পারে।
কিন্তু দুই বিশ্ব পরাশক্তির দ্বন্দ্বে বাংলাদেশ কেন হঠাৎ এতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠলো? বিশ্লেষকরা এর নানা কারণ উল্লেখ করছেন। এর একটি বাংলাদেশের ভৌগলিক অবস্থান। সেই সঙ্গে সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশ যেভাবে নানা অর্থনৈতিক অগ্রগতি অর্জন করেছে, সেটিকেও গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে।
চীনে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফয়েজ আহমেদ বলেন, ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্রাটেজিতে বাংলাদেশ কেন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠলো, তা বোঝা কঠিন নয়। প্রথমত বাংলাদেশের ভৌগলিক অবস্থান। অন্যদিকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং দক্ষিণ এশিয়ার সংযোগস্থলে বাংলাদেশ দাঁড়িয়ে।
কোন দিকে ঝুঁকলো বাংলাদেশ
যুক্তরাষ্ট্রের ফরেন পলিসি জার্নালে একটি নিবন্ধে একজন বিশ্লেষক মাইকেল কুগেলম্যান দাবি করেছেন, বাংলাদেশ আসলে ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্রাটেজির প্রশ্নে পশ্চিমা শক্তির দিকে ঝুঁকেছে।
'বাংলাদেশ টিল্টস টুওয়ার্ড দ্য ইউএস ইন দ্য ইন্দো-প্যাসিফিক' শিরোনামের এই নিবন্ধে মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, বাংলাদেশ বহু দিন ধরে জোট নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করেছে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে বাংলাদেশ ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্রাটেজি পুরোপুরি গ্রহণ করার কাছাকাছি যাচ্ছে। যেটি চীনকে ঠেকাতে ওই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্রদের কৌশল।
অধ্যাপক লাইলুফার ইয়াসমীন বলেন, মাইকেল কুগেলম্যান যেটা লিখেছেন, তার বিরুদ্ধে কিন্তু বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এরই মধ্যে জোরালো প্রতিবাদ জানিয়েছে। আমি নিজেও কিন্তু এটা নিয়ে লিখেছি। বাংলাদেশ আসলে কোনো দেশের দিকেই ঝুঁকছে না। কারণ বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির ভিত্তিই হচ্ছে সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বিদ্বেষ নয়।
বাংলাদেশ যে এই রূপরেখায় মোটেই পশ্চিমা শক্তির দিকে যায়নি, তার প্রমাণ হিসেবে প্রফেসর ইয়াসমীন কয়েকটি বিষয়ের কথা উল্লেখ করছেন।
তিনি বলেছেন, প্রথমত, এই ডকুমেন্টের কোথাও বাংলাদেশ একবারও ‘ইন্দো-প্যাসিফিক রিজিওন’ কথাটি ব্যবহার করেনি। বাংলাদেশ এই পরিকল্পনা থেকে কাউকে বাদ দেয়া বা কাউকে অন্তর্ভুক্ত করা- এ ধরনের বিষয়গুলোকে এড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশ এখানে ইনক্লুসিভিটির ওপর গুরুত্ব দিয়েছে। বাংলাদেশ যে নিরপেক্ষতার নীতিতে বিশ্বাস করে সেই বার্তাটাই দিতে চেয়েছে।
তবে সৈয়দ মাহমুদ আলী মনে করেন, বাংলাদেশ আসলে এক ভারসাম্যপূর্ণ নীতির মাধ্যমে দুই দিক রক্ষার কৌশল নিয়েছে এই রূপরেখায়।
তিনি বলেছেন, ভারতীয় এবং মার্কিন বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বাংলাদেশের রূপরেখা যে দলিলের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়েছে, তাতে ইন্দো-প্যাসিফিক কথাটি বলা, নাম দেয়া, ব্যবহার করা, এবং ভেতরে যে ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে, তাতে একথা প্রচ্ছন্ন, বাংলাদেশ সামরিক দিক থেকে কোয়াড গোষ্ঠীর সঙ্গে হাত মেলায়নি। কিন্তু কূটনৈতিকভাবে সেদিকেই তার ইচ্ছের বহিপ্রকাশ ঘটেছে। সেটি সরাসরি চীন বিরোধী নয়। কারণ বাংলাদেশ বারবার বলছে, তাদের রূপরেখা হচ্ছে ইনক্লুসিভ, অর্থাৎ সব রাষ্ট্রের স্থান আছে এখানে। কোনো রাষ্ট্রকেই বাদ দেয়া হবে না।
কোনো দুর্বল দেশকে ঘিরে যখন বৃহৎ শক্তির দ্বন্দ্ব এবং প্রতিযোগিতা শুরু হয়, তখন সেটি একই সঙ্গে দেশটির জন্য আশীর্বাদ এবং অভিশাপ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই প্রতিযোগিতার সুযোগে দরকষাকষি করে নিজের স্বার্থ আদায়ের সুযোগ যেমন থাকে, তেমনি বৃহৎ শক্তির টানা-হেঁচড়ার মাঝখানে পড়ে অনেক রাষ্ট্রে সংঘাত এবং বিপর্যয়ের নজিরও কম নয়।
সৈয়দ মাহমুদ আলী বলছেন, এই পরিস্থিতিতে নিজের স্বার্থ রক্ষা এবং সেই সাথে ভারসাম্য বজায় রাখা বাংলাদেশের সামনে বেশ বড় একটি চ্যালেঞ্জ।