চোখ দিয়ে আমরা দেখি। এ দেখার প্রধান কাজ করে কর্নিয়া, লেন্স, রেটিনা, অপটিক নার্ভ এবং মস্তিষ্ক। চোখে এক ধরনের স্বচ্ছ লেন্স আছে যা প্রাকৃতিক উপাদানে তৈরি। এটি এক ধরনের উত্তল বা কনভেক্স লেন্স। চোখের অভ্যন্তর ভাগে সামনের অংশে এ লেন্সটির অবস্থান। এই স্বচ্ছ লেন্সের কাজ হলো আলোকরশ্মি যখন চোখের ভেতরে আপতিত হয় তখন আপতিত আলোকরশ্মিকে নিয়ন্ত্রণ করে চোখের পেছনে অবস্থিত সংবেদনশীল পর্দা বা রেটিনার কেন্দ্রবিন্দুতে মিলিত হতে সাহায্য করা। ফলে রেটিনার স্নায়ু উজ্জীবিত হয় এবং মস্তিষ্কে এক ধরনের সংকেত পাঠায়। এর ফলে আমরা দেখতে পাই।
কোনো কারণে যদি প্রাকৃতিক এ লেন্সটি তার স্বচ্ছতা হারিয়ে ফেলে অর্থাৎ ঘোলা হয়ে যায় তবে আলোকরশ্মি চোখের ভিতরে প্রবেশে বাধাগ্রস্ত হয়। এর ফলে দেখার কাজটি বিঘ্নিত হয়। লেন্সের এই ঘোলা অবস্থাটিকে বলা হয় ক্যাটারেক্ট বা ছানি বা মতি।
বিভিন্ন কারণে ছানি পড়তে পারে। এর মধ্যে অন্যতম হলো বয়সজনিত ছানি। বয়স হলে স্বাভাবিক নিয়মে ছানি পড়ে। বিভিন্ন কারণে কম বয়সীদেরও ছানি পড়তে পারে। ছানি পড়ার বিভিন্ন কারণের মধ্যে-আঘাতজনিত, জন্মগতত্রুটি, চোখের প্রদাহ, বিভিন্ন ধরনের রেডিয়েশন বা মাইক্রো/ম্যাক্রোওয়েভ রেডিয়েশন, ডায়াবেটিস ও অন্যান্য মেটাবলিক ডিসঅর্ডার, বিভিন্ন রকমের ওষুধ সেবন যথা স্টেরয়েড ইত্যাদি।
এমনকি একটি শিশুও ছানি নিয়ে জন্মাতে পারে। মাতৃ গর্ভকালীন মায়ের কোনো প্রদাহ বিশেষ করে রুবেলা, টক্সো প্লাজমা ইত্যাদি ভাইরাসের সংক্রমণ অথবা গর্ভকালীন সময়ে ভ্রুণের জিন বা ক্রোমোজমের কোনো ত্রুটিজনিত কারণেও জন্মের সময় বা অব্যবহিত পরে ছানি পরিলক্ষিত হয়। তাকে কনজেনিটাল বা ডেভেলাপমেন্টাল ক্যাটারেক্ট বলা হয়ে থাকে।
যে কারণেই ছানি আসুক না কেন চিকিৎসার তেমন একটা পার্থক্য নাই। সব ধরনের ছানির চিকিৎসা একই এবং তা হলো ছানি অপারেশন। অপারেশনের মাধ্যমে অস্বচ্ছ লেন্স বা ছানি অপারেশন করে সেখানে একটি কৃত্রিম লেন্স প্রতিস্থাপন করাই হলো ছানি অপারেশন। যখন কারও স্বাভাবিক কাজকর্ম ব্যাহত হয়, যেমন বই পড়া, গাড়িচালনা, আলোর বৃত্ত দেখা, দু’টি দেখা, রেটিনা এবং মেকুলার চিকিৎসার জন্য এবং ছানিজনিত জটিলতা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ছানি অপারেশন করা প্রয়োজন। ছানি অপারেশন সঠিক সময়ে করাতে হবে এবং বিলম্ব করলে জটিলতার সৃষ্টি হতে পারে এবং বিলম্বে অস্ত্রোপচারে আশানুরূপ ফল নাও পাওয়া যেতে পারে।
ছানি অপারেশন করাতে গিয়ে একেকজন একেকরকম সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে থাকেন। প্রথমে যে সিদ্ধান্তহীনতাটি মনে উঁকি দেয় তা হলো অপারেশন আপাতত না করালে চলবে কি না অথবা কতদিন অপেক্ষা করা যাবে। দেরিতে অপারেশন করালে কোনো ক্ষতি হবে কি না। ছানি দীর্ঘদিন থাকলে জটিলতা দেখা দিতে পারে। যেমনঃ হঠাৎ চোখের প্রেসার বেড়ে তীব্র ব্যথা ও চোখ লাল এবং সেই সাথে দৃষ্টি একদম চলে যেতে পারে। এটিকে বলা হয় ফেকোলাইটিক গ্লুকোমা। দ্রুত ব্যবস্থা নিতে না পারলে কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে দৃষ্টি স্থায়ীভাবে চলে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে অপারেশন করালেও স্বাভাবিক দৃষ্টি আর ফিরে আসবে না। অতএব ছানি পড়লে চক্ষু বিশেষজ্ঞের পরামর্শে যথাসম্ভব স্বল্প সময়ের মধ্যে অপারেশন করে নেওয়াই উত্তম।
শিশুদের ছানির বেলায় বিষয়টি আরও জটিল। জন্মের সময় শিশুদের দৃষ্টিশক্তি খুবই অল্প থাকে এবং ভূমিষ্ট হওয়ার পর থেকে শিশুর চোখের সম্পূর্ণ পরিপক্কতা পেতে বেশ সময় নেয়। দেখা যায় দৃষ্টিশক্তি সম্পূর্ণ বিকশিত হতে চার থেকে ছয় বছর সময় নিয়ে থাকে। রেটিনা তথা দৃষ্টিশক্তি বিকশিত হতে গেলে আলোর প্রয়োজন। আলোর কাজ হলো চোখের ভেতরে প্রবেশ করে স্নায়ুকে উজ্জীবিত করা। কোনো কারণে যেমন ছানির বেলায় চোখে আলো প্রবেশ বাধাগ্রস্ত হলে রেটিনা উজ্জীবিত হতে না পারার কারণে দৃষ্টিশক্তি বিকশিত হতে পারে না। দৃষ্টিশক্তির এই বিকশিত হতে না পারার অবস্থাকে বলা হয় এমব্লায়োপিয়া। জন্মের পরপরই এই বাধা অর্থাৎ ছানি অপারেশন করে চোখের আলো প্রবেশের পথ সুগম না করে দিলে স্থায়ী অন্ধত্বের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়। তাই যত দ্রুত সম্ভব শিশুদের ক্ষেত্রে ছানি অপারেশন করে নেওয়াই উত্তম। সবচেয়ে ভালো হয় শিশুদের বয়স ২ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই অপরারেশন করিয়ে নেয়া। শিশুদের ছানি সময়মতো অপারেশন না করালে এমব্লায়োপিয়া বা স্থায়ী অন্ধত্ব ছাড়াও চোখ ট্যারা বা স্কুইন্ট এবং নিসটিগামস বা চোখের কাঁপুনির মতো সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে।
সবার মধ্যে যে ভাবনাটি উঁকি দেয় সেটি হলো অপারেশন করালে আগের মতো ভালো দেখব কি না। বিশেষ করে যাদের কোমরবিডিটি যেমন- ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হার্ট বা কিডনির সমস্যা, ক্যান্সার ইত্যাদি আছে। ছানি অপারেশনের পরবর্তী সময়ে কেমন দেখবে এটা চট করে বলা সম্ভব নয়। ছানি অপারেশন হচ্ছে মূলত অস্বচ্ছ লেন্সটি প্রতিস্থাপনের মধ্যেমে চোখের আলো প্রবেশের প্রতিবন্ধকতাটুকু অপসারণ করা।
চোখের অন্য কোনো সমস্যা না থাকলে ধরে নিতে পারি অপারেশনের পর ভালো দেখবে। তবে যাদের ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, কিডনি সমস্যা ইত্যাদি থাকে তাদের বেলায় বিষয়টি ভিন্ন। এ সমস্ত রোগীর বেলায় অনেকের দেহের অন্যান্য অঙ্গের জটিলতার পাশাপাশি চোখের পর্দা বা রেটিনাতেও সমস্যা থাকতে পারে। এমন বয়স্ক লোক যাদের রেটিনাতে সমস্যা আগে থেকেই বিদ্যমান তাদের ছানি অপারেশনের পরও দৃষ্টি সমস্যা কিছুটা থেকে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে প্রয়োজন অপারেশনের আগেই ভালো করে সার্বিক বিষয়ে পরীক্ষা করিয়ে দেখে নেওয়া। যদি এমন সম্ভাবনা আঁচ করা যায় তবে বিষয়টি রোগীকে অবশ্যই আগে থেকেই জানিয়ে রাখতে হবে।
চোখের আরও কিছু সমস্যা আছে। যেমন-গ্লুকোমা, মেকুলার ডিজেনারেশন, রক্তনালী ও রক্তক্ষরণজনিত সমস্যা, চোখের নার্ভের সমস্যা ইত্যাদি যেখানে অপারেশনের পরও অনেক সময় ভালো না দেখার সম্ভাবনা থেকে যায়। এক্ষেত্রে রোগীর করণীয় হলো বিষয়টি নিয়ে চক্ষু বিশেষজ্ঞের সাথে বিস্তারিত আলোচনা করা।
চোখ আপনার, ছানি শনাক্ত হলে সিদ্ধান্ত নিতে হবে আপনাকে। সময় নিয়ে হলেও চক্ষু বিশেষজ্ঞের সাথে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে এবং তার তত্ত্বাবধানেই থাকতে হবে।
লেখক: চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ ও ফ্যাকো সার্জন, পার্কভিউ হাসপাতাল, কাতালগঞ্জ, চট্টগ্রাম।